১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের কথা। চাঁদপুরের গন্ডামারার হাইমচরের তরুণ মাসুদ রানা নকীব যখন শুনলেন প্রিয় তারকা সালমান শাহ এই দুনিয়ায় আর নেই, তখন তিনি শোকে বাকরুদ্ধ! তার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না, অকালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সালমান শাহ চিরদিনের জন্য পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে!
প্রিয় অভিনেতার অকাল মৃত্যুর শোকে অনেকেই আত্মাহুতি দিয়েছেন। অন্য ভক্তদের মতো মাসুদ রানা নকীবও অনেক শোকাহত। তাই বলে অাত্মহত্যা করে ভালোবাসা প্রদর্শনের তত্ত্বে বিশ্বাসী নন তিনি। তখন থেকেই তার মাথায় সালমান শাহকে নিয়ে কিছু করার ভাবনা আসে।
১৯৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মাসুদ রানা নকীব ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠান করেন সালমান শাহ স্মৃতি সংসদ নামের একটি ফ্যান ক্লাব। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির মাধ্যমে রূপালি পর্দায় সালমানের আগমনের পর থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত তাকে নিয়ে প্রকাশিত ম্যাগাজিন, পত্রিকা ও ভিউকার্ডসহ অনেক কিছু সংগ্রহ করেন তিনি।
সালমান শাহর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মরণে মিলাদ মাহফিলসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করতেন মাসুদ রানা নকীব। বিশেষ করে সালমানের জন্মদিনে তিনি প্রায়ই নানান খেলাধুলার আয়োজন করতেন। নিজ উদ্যোগে বিজয়ীদের পুরস্কার প্রদান করতেন।
প্রতি বছর সালমান শাহর ছবিসহ এক পৃষ্ঠার ক্যালেন্ডার বের করে বিতরণ করতেন স্থানীয়দের মধ্যে। সালমানের বড় বড় ছবি বাঁধাই করে মাসুদ রানা নকীব নিজ এলাকার দোকান, সেলুন, স্টুডিও এবং হোটেল-রেস্তোরাঁয় টাঙিয়ে দিয়েছেন। সালমান শাহ স্মৃতি সংসদের কার্যালয়ে প্রায় রাতেই ভিসিআরে প্রয়াত অভিনেতার ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতেন তিনি।
মাসুদ রানা নকীবের এসব কর্মকাণ্ডের কারণে অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করতেন ও তাকে উন্মাদ ভাবতেন! এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি সালমান শাহকে খুব ভালোবাসি ও শ্রদ্ধা করি। তাই সবসময় চেয়েছি তিনি যেন সবার মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকেন।’
সালমান শাহকে নিয়ে মাসুদ রানা নকীবের এতো পাগলামি বাবা মোটেই পছন্দ করতেন না। ২০০২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তার আয়োজনে স্থানীয় মসজিদে মিলাদ হয়। মিলাদ শেষে তিনি বাড়ি ফিরে দেখেন সালমানের বাঁধানো বড় বড় সব ছবি বাবা পুকুরে ফেলে দিয়েছেন। রাগে-ক্ষোভে এই অন্ধভক্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, কিন্তু বাবাকে কিছু বলার সাহস পাননি। অভিমানে তিন দিন ঘরে কোনো খাবার খাননি তিনি। ছোট ভাই মাহিদকে চড়ও মেরেছিলেন। তাই বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে নকীবকে অনেক মারধর করেন এবং বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন। এ-ও বলেন, ‘যেদিন সালমান শাহকে ভুলতে পারবি সেদিন আমার বাড়িতে আসবি, নইলে না।’
এরপর মাসুদ রানা নকীব রাগ করে বাড়ি থেকে চলে আসেন ঢাকায়। এখানে এসেও মোহাম্মদপুরে আবার সালমান শাহ স্মৃতি সংসদের কার্যক্রম শুরু করেন। সংগঠনটি ঠিকভাবে চালানোর টাকা জোগাড়ের জন্য কয়েক মাস নির্মাণ শ্রমিকের কাজও করেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে সালমান শাহ স্মৃতি সংসদ নামে একটি ফ্যানপেজ রয়েছে, এর অ্যাডমিন তিনি নিজেই। এই পেজের মাধ্যমে ভক্ত ও ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে জনমত তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার লক্ষ্য সালমান শাহর নামে বিএফডিসির সামনের সড়ক অথবা বিএফডিসির অভ্যন্তরে একটি স্থাপনা বা সড়কের নামকরণের মাধ্যমে তাকে যেন চিরস্মরণীয় করা হয় এবং সালমানের স্মৃতিগুলো যেন ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
এ দাবির কথা জানিয়ে গত ১৯ বছর ধরে মাসুদ রানা নকীব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তথ্য সচিব, তথ্যমন্ত্রী বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বর্তমান সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি।
মাসুদ রানা নকীব বিএফডিসির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তাকে শুনতে হয়েছে, সালমানের নামে কোনো কিছু করার পরিকল্পনা তাদের নেই। তবে শিল্পী সমিতির পক্ষ থেকে যদি আবেদন করা হয় তাহলে তিনি তা বিবেচনা করবেন।
একথা শোনার পর সেদিনই একটি চিঠির মাধ্যমে মাসুদ রানা নকীব শিল্পী সমিতির বর্তমান সভাপতির কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন, তাদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী ও বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে আবেদন করা হয়।
অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই মাসুদ রানা নকীব বলেন, ‘শিল্পী সমিতির নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের বেশিরভাগই সালমানের সহকর্মী ও আপনজন। তারা কেনো এই বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না তা আমাদের বোধগম্য নয়।’
যোগ করে নকীব আরও বলেন, সালমান শাহ স্মরণে বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ যদি কিছু না-ই করে, তাহলে আমাদের এলাকায় প্রিয় অভিনেতার নামে একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করবো। এজন্য সবার দোয়া চাই।’
* তথ্য সংগ্রহ সহযোগিতায় : সালমান শাহর ভক্ত কাজল পাটোয়ারী
No comments:
Post a Comment