ইন্টারনেট শব্দটির মধ্যে যেন জাদু আছে। ছোটবেলা থেকেই আমাকে গ্রাস করেছিল সেই জাদু। বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন ব্যাংকার। বরগুনা শহরে আমাদের বাড়িতে প্রথম আলো রাখতেন। আমার বিশেষ আকর্ষণের পাতা ছিল ‘কম্পিউটার প্রতিদিন’ ও ‘প্রজন্ম ডট কম’।
২০০৬ সালে আমি বরগুনা জিলা স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। বাবা নিজের ও বড় ভাইয়ের জন্য দুটি ইন্টারনেট-সমর্থিত মুঠোফোন কিনলেন। ছোট হওয়ায় সেগুলো স্পর্শ করা বারণ ছিল আমার। কিন্তু আমার ভেতরে তখন কিলবিল করছিল ইন্টারনেটের পোকা। ইচ্ছে হতো ফোন দুটো ছঁুয়ে দেখার। অনেক ফন্দি-ফিকির করে বড় ভাইকে অবশেষে একদিন রাজি করালাম। ফোন হাতে নেওয়ার অনুমতি মিলল। এরপর মাঝে মাঝেই ভাইয়ার মুঠোফোনটি নিয়ে বিভিন্ন অ্যাপস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। ভাইয়া তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ফোন নিয়ে চলে গেলেন ঢাকায়। মনে হচ্ছিল আমি একা হয়ে গেছি। পরে বাবাকে অনেক বুঝিয়ে পত্রিকা ঘেঁটে ইন্টারনেট চালু করার নিয়মকানুন জেনে নিয়ে তাঁর মুঠোফোনে ইন্টারনেট চালু করি।
প্রথম যখন গুগলে ক্লিক করি তখন আমার কাছে সবকিছু আজব লাগল। কত ছবি! কত লেখা! কত সংবাদ! এরপর মুঠোফোন আর ইন্টারনেট আমার একমাত্র নেশা।
পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছিলাম। স্বপ্ন ছিল বড় চিকিৎসক হওয়ার। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিও পেয়েছিলাম। এসএসসিতে ভালো ফলের বদৌলতে বৃত্তির জমানো টাকায় কিনে নিয়েছিলাম ইন্টারনেট-সমর্থিত একটি মুঠোফোন।
২০১১ সালের ১১ অক্টোবর বরগুনায় হলো ‘গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ইন্টারনেট উৎসব’। আমি তখন বরগুনা সরকারি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। খুব আগ্রহ নিয়ে অংশ নিলাম ওই উৎসবে। প্রায় ৫০০ প্রতিযোগীকে টপকে নির্বাচিত হলাম বরগুনা জেলার ‘আই-জিনিয়াস’।
২০০৭ সালের শেষের দিকে বাবা গ্রামের বাড়ির জমিজমা নিয়ে হঠাৎ কয়েকটি মামলায় জড়িয়ে পড়েন। ২০০৯ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন। কিন্তু পেনশনের পুরোটাই শেষ মামলার পেছনে। পরিবারে দেখা দেয় চরম আর্থিক অনটন। দুই ভাই ও এক বোনের পরিবারে মা-বাবার ছোট সন্তান আমি। ভাই ও বোন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। বাবার পেনশনের টাকা ছাড়া আয়ের কোনো বিকল্প উৎস ছিল না তখন। পরিবারের ভরণপোষণ, ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচ জোগানো বাবার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ল।
আমাদের প্রধান পুঁজি ‘গুডউইল’। যখন সবাইকে নিয়ে কাজ করি এবং নিজেদের সাফল্যের কথা চিন্তা করি তখন বুকটা আনন্দে ভরে ওঠে। আমি মনে করি, গভীর মনোযোগ আর নিরলস পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না
২০১২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিই। আর্থিক অনটনের প্রভাবে মানসিক বিপর্যয়ের ফলে ফল কিছুটা খারাপ হয়। তবু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল প্রবল। কিন্তু টাকার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কোচিংয়ে ভর্তি হতে পারিনি। কী করব, কী করা উচিত ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না। চাকরি খুঁজতে শুরু করলাম। হন্যে হয়ে ঘুরেও কোনো চাকরি জুটল না।
পত্রিকায় আউটসোর্সিং সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদ ও নিবন্ধ পড়ে আমার এ বিষয়ে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এটা করতে গেলে লাগে নিজের কম্পিউটার, যোগাযোগ ও প্রশিক্ষণ। আমার সে ধরনের দক্ষতা ও আর্থিক সামর্থ্যও নেই। তা ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলে তখন এ বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণকেন্দ্রও ছিল না। তারপরও হাল ছাড়ি না। বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে জানার চেষ্টা করি। জানলাম, আউটসোর্সিংয়ের কাজগুলো ঘরে বসেই করা যায়, এখানে বয়স বা শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনো সমস্যা নয়। সিদ্ধান্ত নিলাম আউটসোর্সিংয়ে ক্যারিয়ার গড়ার। কিন্তু বরিশাল অঞ্চলে এ-বিষয়ক কোনো প্রশিক্ষণকেন্দ্র না থাকায় আমার চিন্তাটা স্তিমিত হলো। মাস দুয়েক পর আমার মুঠোফোনটি বিক্রি করে পাঁচ হাজার টাকা পেলাম। কিন্তু এই টাকা দিয়ে ঢাকায় থাকা, তিন মাসের প্রশিক্ষণ ব্যয় মেটানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিষয়টি মাকে খুলে বলি। মা আমার আগ্রহ দেখে তাঁর কিছু স্বর্ণালংকার আমাকে বিক্রি করতে দিলেন। অলংকার বিক্রির ১৫ হাজার ও আমার ৫ হাজার মিলে ২০ হাজার টাকা নিয়ে ঢাকায় গেলাম। ভর্তি হলাম একটি আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণকেন্দ্রে।
২০১২-এর ডিসেম্বরে কোর্স শেষ করে বরগুনায় ফিরে আসি। ২০১৩ সালে এইচএসসিতে মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফল করি। এ বছরই জুলাই মাসে আমেরিকান অনলাইন মার্কেটপ্লেস ‘ইল্যান্স’ ও অন্যান্য মার্কেটপ্লেসে কাজ শুরু করি। ৩২ ডলারের চুক্তিতে ইন্দোনেশীয় এক প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল এটা। কিন্তু গ্রাহক আমার কাজে তেমন সন্তুষ্ট হলেন না। কাজ মনঃপূত না হওয়ায় তাঁরা আমাকে মাত্র ১০ ডলার পারিশ্রমিক দিলেন। অর্থের জন্য নয় বরং জীবনের প্রথম কাজটি খারাপ হওয়ার জন্য মন খারাপ হলো। কিন্তু আমি হতাশ না হয়ে বইপত্র ও অন্যান্য মাধ্যমে পড়াশোনা করে নিজের দক্ষতা বাড়ানোর নিরলস চেষ্টা করি। মাস দুয়েক পর আমেরিকার ‘ফিফথ থাম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৪০০ ডলারে চুক্তিবদ্ধ হই। কাজ শেষ করে গ্রাহককে তা জমা দেওয়ার পর মন দুরু দুরু করছিল। কিন্তু তারা কাজ দেখে খুশি হয়ে আমাকে ৪০০ ডলারের জায়গায় ৪৫০ ডলার পারিশ্রমিক দিল। এতে আত্মবিশ্বাস দ্বিগুণ হয়ে গেল। সব জড়তা ঝেড়ে আমি কাজে মন দিলাম। ৩০ হাজারের বেশি টাকা আয় হতে থাকে আমার। পরিবারে অনেকটা সচ্ছলতা আসে। খুব ভালো লাগে আমার। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে কাজ। কিন্তু মনের মধ্যে উচ্চশিক্ষার স্বপ্নটাও পুষে রাখি।
কয়েক দিনের মাথায় আমার কম্পিউটারে কারিগরি ত্রুটি হয়। এবার ‘ফিফথ থাম’ আমাকে কম্পিউটার কেনার জন্য অগ্রিম ১ হাজার ৩০০ ডলার দেয় এবং মাসিক ৭০০ ডলারে আমার সঙ্গে এক বছরের চুক্তি করে। বর্তমানে আমরা আমেরিকার ‘ড্রাগ ডেঞ্জার ডটকম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অনলাইন বাজারজাতকরণের কাজ করছি। দুই বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সপ্তাহে এক হাজার করে মাসিক চার হাজার ডলারের চুক্তিতে কাজ করছি। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইসরায়েল ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েব ডিজাইন ও অনলাইন মার্কেটিংয়ের কাজ করছি।
আমি মনের মধ্যে তাগিদ অনুভব করি যে বেকার তরুণ-যুবকদের উন্নয়নে আমার দক্ষতা কাজে লাগানো উচিত। সিদ্ধান্ত নিই বরগুনা শহর ও অন্য উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আউটসোর্সিংয়ের কাজে আগ্রহী করার। কিন্তু বরগুনার তরুণদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তিগত জ্ঞান ও ধারণা সীমিত। তবু চেষ্টা থামাই না। প্রথমে বরগুনা সরকারি কলেজের একজন-দুজন করে আউটসোর্সিংয়ের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করি। মাস খানেকের মধ্যে অনেকের সাড়া পাই। এদের মধ্যে ৩০ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে বরগুনা সরকারি কলেজে তিন দিনের একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করি। পরে বরগুনা সদর, বামনা, আমতলী ও পাথরঘাটা উপজেলার অন্তত ১১টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে পৃথক পৃথক কর্মশালার আয়োজন করি। এতে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে বেকার তরুণ-যুবকেরা আমার কাছে আসতে থাকে। জানতে চায় আউটসোর্সিং সম্পর্কে। এরপর প্রশিক্ষণকেন্দ্র করার চিন্তা মাথায় আসে। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে এ নিয়ে কথাও বলি। ২০১৪ সালের ১৮ অক্টোবর শহরের সদর রোডে সাত হাজার টাকায় একটি বাড়িভাড়া নিয়ে ‘রাকিবস আইএলসি’ নামে আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণকেন্দ্র শুরু করি। চারজন বেকার যুবককে তিন-চার হাজার টাকা করে মাসিক পারিশ্রমিক দিয়ে যাত্রা শুরু হয় প্রতিষ্ঠানের।
মাস চারেক যেতেই প্রশিক্ষণার্থীদ
ের আগ্রহ আর ব্যাপক সাড়ায় প্রতিষ্ঠানের কলেবর বাড়াতে শহরের নজরুল ইসলাম সড়কের প্রশিক্ষণকেন্দ্রটি স্থানান্তর করতে হয়। বর্তমানে এক হাজার বর্গফুট আয়তনের এই কেন্দ্রটির ভাড়া প্রায় ১০ হাজার টাকা। গত এক বছরে এই প্রতিষ্ঠান থেকে চারটি সেশনে ১২০ জন আউটসোর্সিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ৩০ জন রয়েছেন, যাঁরা বিনা খরচে এখানে প্রশিক্ষণ পেয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। প্রশিক্ষণ পাওয়াদের মধ্যে ১১ জন বর্তমানে আমার প্রতিষ্ঠান ‘রাকিবস আইএলসিতে’ কাজ করছেন। এঁদের পারিশ্রমিক ৭ থেকে ১৫ হাজার টাকা। আমরা সবাই মিলে পরিশ্রম করে তিলে তিলে প্রতিষ্ঠানটিকে সমৃদ্ধ করছি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের মাসিক আয় আড়াই লাখ টাকার বেশি। আয় প্রতি মাসেই বাড়ছে। আমাদের কাজের মান, দক্ষতা ও সৃজনশীলতায় মুগ্ধ হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামকরা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আজ আমাদের ওপর ভরসা করছে। কিন্তু আমাদের প্রধান পুঁজি ‘গুডউইল’। যখন সবাইকে নিয়ে কাজ করি এবং নিজেদের সাফল্যের কথা চিন্তা করি তখন বুকটা আনন্দে ভরে ওঠে। আমি মনে করি, গভীর মনোযোগ আর নিরলস পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না।
যাঁরা আউটসোর্সিং শুরু করতে চান তাঁদের বলব, একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ভালোভাবে দক্ষ হয়ে কাজ শুরু করতে পারলে ব্যর্থ হবেন না কখনোই। আউটসোর্সিংয়ে এসে কাজ পান না বলে হতাশায় ভুগতে শুনি অনেককে। আসলে প্রথম দিকে কাজ পাওয়া নিয়ে কিছুটা সমস্যা থাকলেও লেগে থেকে নিজের দক্ষতা বাড়াতে পারলে সফলতা আসবেই।
ছোটবেলা থেকে দেখেছি, পরিবার ও সমাজ আমাদের একটি ভয়ংকর প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে দেয়। শিক্ষাক্ষেত্রে, সামাজিকতা এমনকি ভালো চাকরি পাওয়ার এই প্রতিযোগিতা আমাদের তরুণসমাজের মননশীলতা ও দক্ষতা অর্জনের স্পৃহা নষ্ট করে দেয়। কিন্তু মানুষ হতে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে কোনো প্রতিযোগিতা এখানে হয় না। সময় বদলেছে, তাই আমাদেরও বদলাতে হবে। তরুণ প্রজন্মের উচিত চাকরির ওপর নির্ভরতা কমানো এবং নিজেকে সম্পদে পরিণত করার প্রয়াস চালানো। রাষ্ট্র বা অন্য কে কী দিল সেই হিসাব না করে নিজেকে উদ্যোক্তায় পরিণত করতে পারলে নিজের উন্নতির পাশাপাশি দেশকেও এগিয়ে নেওয়া যায়।
(অনুলিখন)
রাকিবুল ইসলাম, প্রতিষ্ঠাতা রাকিবস আইএলসি, বরগুনা
No comments:
Post a Comment