বাঙালি বাবা ও তাঁর বিশ্বজয়ী কন্যা - সময়ের প্রতিধ্বনি

Breaking

Home Top Ad

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Thursday, September 8, 2016

বাঙালি বাবা ও তাঁর বিশ্বজয়ী কন্যা

বাবার কোলে ছোট্ট রিতা। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত
বাবার কোলে ছোট্ট রিতা। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে সেরা অ্যাথলেটদের একজন মার্গারিতা মামুন। সদ্য শেষ হওয়া রিও অলিম্পিকে রাশিয়ার হয়ে স্বর্ণপদক জিতেছেন, রিদমিক জিমন্যাস্টিকসের বিশ্ব র্যা ঙ্কিংয়ে ১ নম্বরে আছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই তরুণী। তাঁর বাবা আবদুল্লাহ আল মামুনের পৈতৃক নিবাস রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার কাশিপুর গ্রামে।
তাই রাশিয়ার জাতীয় রিদমিক জিমন্যাস্টিকস দলের কোচ ইরিনা ভিনের দেওয়া উপাধি ‘বাংলার বাঘিনী’ নামেই বিশ্বগণমাধ্যমে সুপরিচিত মার্গারিতা।
বাঙালি বাবার কাছ থেকে বাঘিনীর বেড়ে ওঠার গল্পটা শোনার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু গত ২৬ আগস্ট আবদুল্লাহ আল মামুন চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। ২৫ আগস্ট রাতেও তাঁর ব্যক্তিগত নম্বরে দুবার ফোন করেছি, সাড়া পাইনি। পরে জেনেছি, এক মাস ধরেই ঠিকমতো কথা বলতে পারতেন না তিনি।
রিও থেকে সোনার পদক নিয়ে মেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। রিতার পরিবারের সবারই তো বাঁধভাঙা উল্লাসে ফেটে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু আনন্দের ওই রেশটুকু কাটতে না-কাটতেই নেমে এল গভীর শোকের ছায়া। দুই বছরের বেশি সময় ধরে জটিল রোগে ভুগছিলেন রিতার বাবা মামুন। ছিলেন মস্কোর নামকরা চিকিৎসকদের নিবিড় পরিচর্যায়। মেয়ের অলিম্পিক-জয়ের আনন্দটুকুই তাঁর চোখে এনে দিয়েছিল জীবনের শেষ আনন্দাশ্রু


বাঘিনীর বাবা
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে কাশীপুর গ্রাম। সেই গ্রামের আবদুল খালেক ও মেহেরুন নিসা দম্পতির সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট আবদুল্লাহ আল মামুন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। কিন্তু সেখানে ক্লাস শুরুর আগেই ১৯৮৪ সালে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পাড়ি জমান তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে। ভর্তি হন আস্ত্রাখান স্টেট টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে)। এখানেই তাঁর পরিচয় হয় রাশিয়ান তরুণী আন্না মারাদিকার সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে তাঁকে বিয়ে করে রাশিয়ায় শুরু হলো মামুনের সংসারজীবন।
১৯৯৫-এর ১ নভেম্বর। মস্কোতে এই দম্পতির ঘরে জন্ম নিলেন রিতা।
দুই ভাইবোনের মধ্যে রিতা বড়। ছোট ভাইয়ের নাম ফিলিপ। রিতার বয়স যখন সাত বছর, তখন থেকেই তিনি শুরু করেন রিদমিক জিমন্যাস্টিকস চর্চা। বাবা-মা দুজনেরই স্বপ্ন ছিল, মেয়ে হবেন বড় মাপের অ্যাথলেট, জগৎজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে তাঁর নাম।
জিমন্যাস্টিকসে ক্যারিয়ার গড়তে ১১ বছর বয়স থেকে কঠোর অনুশীলনে নামেন রিতা। জুনিয়র পর্যায়ে তিনি অংশ নিয়েছেন বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে। ২০০৫ সালে এস্তোনিয়ায় অনুষ্ঠিত মিস ভ্যালেন্টাইন কাপে প্রথমবারের মতো যৌথভাবে অংশগ্রহণ করেন। জুনিয়র পর্যায়ে বাংলাদেশের হয়েও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
মস্কোর নিজ বাড়িতে সপরিবারে রিতা। ছবি: প্রথম আলোরিতার বিশ্বসেরা হয়ে ওঠা
জুনিয়র লেভেল থেকে সিনিয়র লেভেলে অংশ নিতে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করেন রিতা। তাঁর ক্যারিয়ারে বড় সাফল্য আসে ২০১১ সালে। ওই বছর রাশিয়ার চ্যাম্পিয়নশিপে হুপ ও বলে অল-অ্যারাউন্ড চ্যাম্পিয়ন হলে ডাক পান জাতীয় দলে। এরপর?
তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রিদমিক জিমন্যাস্টিকসের প্রতিটি ক্রীড়া আসরে পেয়েছেন অভাবনীয় সাফল্য। ২০১৩-এর ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে ও কাজানের গ্রীষ্মকালীন ইউনিভার্সিয়াডে অল-অ্যারাউন্ড চ্যাম্পিয়নশিপে অক্ষুণ্ন রেখেছেন সাফল্যের ধারাবাহিকতা। রিদমিক জিমন্যাস্টিকসের ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে টানা তিন বছর ধরে অল-অ্যারাউন্ড ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন তিনি।
রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে বিশ্ব রেকর্ডও আছে তাঁর দখলে। ২০১৬ সালে বাকু বিশ্বকাপে চারটি ইভেন্টে মোট ৭৭.১৫০ পয়েন্ট নিয়ে গড়েন বিশ্ব রেকর্ড। আর রিও অলিম্পিকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তো সারা বিশ্বে তাঁকে নিয়ে রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে। ইউরোপের একটি টেলিভিশন চ্যানেল দুই বছর ধরে রিতাকে নিয়ে তৈরি করেছে প্রামাণ্যচিত্র। জানা যায়, শুধু রিতার পেছনেই রাশিয়ার জাতীয় রিদমিক জিমন্যাস্টিকস দলের ২১ জন কলাকুশলী কাজ করেন।
বাংলার টান
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। মস্কোর গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স শেষ করে সবে পিএইচডিতে ভর্তি হয়েছি। সে সময় প্রথম আলোর জন্য রিতার একটি সাক্ষাৎকার নিতে মস্কোর ইউগো-জাপাদনায়া এলাকায় তাঁদের বাড়িতে যাই। সেদিনই তাঁর বাবা-মা ও ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার প্রতি রিতার যে মমত্ববোধ রয়েছে, তা জানতে পারি ওই দিনই। খুব একটা ভালো বাংলা না জানলেও ভাঙা ভাঙা কিছু বাংলা শব্দ বলতে পারেন তিনি। সেবার আমাদের অনুরোধে বাংলায় ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গুনে শুনিয়েছিলেন। বাবা মামুন ও কাছের বাঙালি স্বজনদের কাছ থেকেই একটু একটু বাংলা শিখেছেন। মেয়েকে নিয়ে প্রায়ই বাংলাদেশে বেড়াতে আসতেন আবদুল্লাহ আল মামুন। রিতার পরিবার সূত্রে জানা যায়, রিতাকে নিয়ে শেষবারের মতো বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০০২ সালে। মেয়ের অসাধারণ ক্রীড়ানৈপুণ্যের কারণে বাবা হিসেবে অত্যন্ত গর্ববোধ করতেন মামুন। মস্কোর বাড়িতে বসে প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, ‘যেহেতু আমি বাঙালি, তাই মেয়ের যেকোনো সাফল্যকে শুরুতে একজন বাঙালি হিসেবে অনুভব করি।’ মেয়ের সাফল্যের পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি? জবাবে রিতার বাবা বলেন, ‘ও অনেক পরিশ্রমী মেয়ে। নিজের চেষ্টায়ই এত দূর এসেছে। আর আমাদের ভালোবাসা তো ছিলই।’
আবদুল্লাহ আল মামুন যখন মস্কোর নিজ বাড়িতে জীবনের শেষ দিনগুলো পার করছিলেন, রিতা তখন রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করতে ছিলেন ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে। বাবার অসুখের সব খবরই জানানো হতো মেয়েকে। রিতাও প্রতিদিন ফোন করে মামুনের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিতেন। রিদমিক জিমন্যাস্টিকস নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও বাবা ছিলেন তাঁর ভাবনার জগতের পুরোটাজুড়ে। অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে নিজের অর্জিত স্বর্ণপদকটি তাই বাবার নামেই উৎসর্গ করেন বাংলার বাঘিনী। অলিম্পিকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় সংবাদমাধ্যমকে রিতা বলেছিলেন, ‘আমার প্রতিটি হুপ, বল, ক্লাব ও রিবন বাবার জন্য উৎসর্গ করেছি।’
জন্মসূত্রে তিনি রাশিয়ান। কিন্তু তাঁর হৃদয়ে আবদুল্লাহ আল মামুনের রেখে যাওয়া এক টুকরা বাংলাদেশ—নিশ্চয় এটা এখন রিতার পরম সঞ্চয়!

No comments:

Post a Comment

Post Bottom Ad

Responsive Ads Here

Pages