নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদী দখল করে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেছে সিটি
রাজধানীর চারপাশের নদী দখলমুক্ত রাখতে সরকারি তৎপরতা হাঁকডাকেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ওই সব নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে বরাদ্দ রাখা অর্থ আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দেওয়া ‘গাইড লাইন’ যেন কোনো কাজেই আসছে না। নদীর সীমানা নির্ধারণ করে বসানো সীমানা পিলারকে কেউ তোয়াক্কাই করছে না।
দখলদারদের থাবায় শীতলক্ষ্যার সীমানা পিলারেরও অস্তিত্ব নেই। মাটি ভরাট করে দখলবাজরা নদীর কিছু কিছু অংশকে যেন ক্ষীণধারার খালে পরিণত করেছে। শীতলক্ষ্যায় এমন সর্বগ্রাসী দখলবাজদের তালিকার শীর্ষে রয়েছে সিটি গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে প্রায় ৩০০ বিঘা জমি নিয়ে একটি প্রকল্প করা হয়েছে। শীতলক্ষ্যার কূল ঘেঁষে গড়ে তোলা এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে একদিকে নদী দখল, অন্যদিকে সরকারি খাসজমি ও খাল দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, শত শত মানুষের জমিও ওই গ্রুপটি দখল করে ভরাট করে ফেলছে। বিশাল আকৃতির সাতটি ড্রেজার দিন-রাত ভরাটকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। শীতলক্ষ্যা নদী দখল করে গড়ে তোলা সিটি গ্রুপের স্থাপনাগুলো উচ্চ আদালতের রায়ের পরও উচ্ছেদ হয়নি। কর্তৃপক্ষ বলছে, ওই সব অবৈধ স্থাপনা ভাঙতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জমান নেই তাদের হাতে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নদীর পাড়ে শিল্প-কারখানা করতে হলে বিশেষ করে নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। সিটি গ্রুপ নদী দখল করে কিভাবে স্থাপনা করেছে তা বুঝি না। সরকারের উচিত আইন প্রয়োগ করে নদী রক্ষায় আরো সক্রিয় হওয়া।’
এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) যুগ্ম পরিচালক (নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর) এ কে এম আরিফ উদ্দিন বলেন, ‘সিটি গ্রুপের দখলবাজির ব্যাপারে আমরা অবগত আছি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ স্থাপনা এত বিশাল যে, তা ভাঙার মতো সরঞ্জাম আমাদের কাছে নেই। যে কারণে আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে মাননীয় আদালতে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছি। এ ছাড়া নদীর সীমানা পিলার উপেক্ষা করে নতুন করে কেউ যদি জমি দখলে নামে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ভরাটে সাত ড্রেজিং ৪৯ শ্রমিক : সরেজমিন রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের শীতলক্ষ্যা নদী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মেসার্স মেহেরাজ এন্টারপ্রাইজ, এডিএফ-১ ও তিথি এন্টারপ্রাইজ নামের তিনটি ড্রেজারসহ সাতটি ড্রেজার বালু তুলছে। বালু উত্তোলন করে মোটা পাইপ দিয়ে নিচু জমি ভরাট চলছে। এখানে প্রায় শত একর জমি ভরাট করতে সিটি গ্রুপের পক্ষে অর্ধশত শ্রমিক কাজ করছে। সেখানে কর্মরত শ্রমিক নেতা গিয়াস উদ্দিন ও ইব্রাহিম জানান, সিটি গ্রুপ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁরা চুক্তিতে ভরাটকাজ করছেন। এখানে তাঁদের সাতটি ড্রেজারে মোট ৪৯ জন শ্রমিক কর্মরত আছে।’ দখলি জমিতে ভরাট বিষয়ে এবং এসব ভরাটের অনুমোদন আছে কি না জানতে চাইলে তাঁরা ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
নদীর পিলার মাটির নিচে : সরকার শীতলক্ষ্যা রক্ষায় শত কোটি টাকা খরচ করে সীমানা নির্ধারণ করে পাঁচ হাজার ১১টি পিলার বসিয়েছে। কিন্তু দখলদাররা সীমানা পিলার এলাকা ভরাট করে দখলবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। কায়েতপাড়ার প্রায় অর্ধশত সীমানা পিলার মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলেছে সিটি গ্রুপের লোকজন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শীতলক্ষ্যার পাড়ে ১২১৬ নম্বর থেকে শুরু করে ১৩৪৬ নম্বর পিলারের মাঝখানে থাকা প্রায় সবই বালুমাটিতে ঢেকে ফেলা হয়েছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিটি গ্রুপের লোকজন দুই মাস আগে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মেশিন দিয়ে শীতলক্ষ্যার পাড় দখল করে নিজেরা নতুন করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে। এখানে সরকারের দেওয়া সীমানা পিলারও তারা ঢেকে দিয়েছে।
কৃষকের মাথায় হাত : সরকার কৃষিজমি রক্ষায় জোর দিলেও খোদ রাজধানীর উপকণ্ঠ রূপগঞ্জে তা লঙ্ঘিত হচ্ছে। কৃষকদের ফসলি জমি নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করে সেখানে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। আবার অনেকে জমি বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় সেগুলো জোর করে দখল করে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের শীতলক্ষ্যার তীরঘেঁষা পূর্বগ্রামের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির খান বলেন, ‘১০ শতাংশ জমিও রাস্তার পাশ থেকে ক্রয় করেনি সিটি গ্রুপ। আর প্রকল্পের ভেতরে অনেক মানুষের জমি রয়েছে। সেগুলোতে এখন আর কাউকে ফসল করতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা অনেকে জমি বিক্রি করতে চাই না। সেখানে নিজেরা কিছু করব বা ফসল ফলাব তা আর এখন সম্ভব না।’ স্থানীয় আরেক বাসিন্দা সুরুজ মিয়া বলেন, ‘আমরা নিরীহ মানুষ। আমাদের জমি না কিনেই সেখানে ভরাট শুরু করেছে। আমরা প্রশাসনের উদ্যোগের দিকে তাকিয়ে আছি।’ স্থানীয় আরেক বাসিন্দা সামসুন্নাহারের রয়েছে ৩০ শতাংশ জমি। সামসুন্নাহারের স্বামী সরকারি কর্মকর্তা দ্বীন মোহাম্মদ সরকার বলেন, ‘আমাদের যে জমি রয়েছে তা বিক্রি করব না। কিন্তু সিটি গ্রুপ তাদের দখলে ওই জমি নিয়ে নিয়েছে। এ জমির জন্য প্রয়োজনে সব ধরনের আইনি লড়াই করব।’ পূর্বগ্রামের মৃত সিরাজ উদ্দিনের সাত ছেলে। এর মধ্যে ইব্রাহিম নামের একজন মুদি দোকানদার। ইব্রাহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সাত ভাই। আমাদের বাড়ির জমি কম থাকায় এখন ফসলি জমিতে বাড়ি করতে হবে। কিন্তু এ জমি ঘিরে বালু ভরাটের প্রস্তুতি নিচ্ছে সিটি গ্রুপ। এখন তারা নামমাত্র টাকা দিতে চায়। আমরা বলেছি, টাকা নিয়ে কী করব। আমাদের বাড়ি বানাতে জমি দরকার। এ অবস্থায় আতঙ্কে আছি জমি নিয়ে।’
নদী রক্ষা করবে কে : নদী দখল ও দূষণ রোধে সরাসরি ১৫টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজের আওতায় রয়েছে নদীর পানিদূষণ রোধ করা। বিআইডাব্লিউটিএর দায়িত্ব তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা, নদীর পানি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের, নদীর সীমানার ভূমির দায়িত্ব ভূমি মন্ত্রণালয়ের, পাড়ের মালিক নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। নদী দখলমুক্ত রাখতে প্রয়োজন পুলিশের ভূমিকা। এত কর্তৃপক্ষ থাকতেও নদী দখল এবং দূষণ রোধ করা যাচ্ছে না। শীতলক্ষ্যার পাড়ে থাকা সিটি গ্রুপের বিশাল আকৃতির শিল্প-কারখানা থেকে প্রতিদিন ক্রোমিয়াম, পারদ, ক্লোরিনসহ এসিড, দস্তা, নিকেল, সিসা, ফসফোজিপসাম, ক্যাডমিয়াম, লোগাম অ্যালকালি মিশ্রিত বর্জ্য গিয়ে পড়ে শীতলক্ষ্যায়। এ ছাড়া সিটি গ্রুপের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যবহৃত অর্ধশতাধিক জাহাজ নদীতে দাঁড়িয়ে থাকায় নদীর স্বাভাবিক গতিও ব্যাহত হচ্ছে।
নদী রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশ উপেক্ষিত : শীতলক্ষ্যা রক্ষায় বিভিন্ন সময় সরকারি উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত নদী বাঁচাতে শুরু হয় আইনি লড়াই? হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের করা রিট আবেদনের শুনানির পর নদীর সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট বিভাগ, যা পরবর্তী সময়ে আপিল বিভাগেও বহাল থাকে? রায়ে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা এখন সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আদালতের আদেশের পরও শীতলক্ষ্যা দখলের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের একটি স্থাপনাও উচ্ছেদ করা হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সিটি গ্রুপের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একজন প্রভাবশালীর চাপে আর তা উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। রিট আবেদনকারী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে এসব অবৈধ স্থাপনা ভাঙার কথা। এখানো কেন ভাঙা হয়নি তা বুঝতে পারছি না। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে।’
খালও দখল : সিটি গ্রুপ শুধু নদী নয় তাদের নতুন প্রকল্পের ভেতরে থাকা খাসজমি ও একটি খাল দখলে নিয়েছে। চনপাড়া, পূর্বগ্রাম, কায়েতপাড়াসহ এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য যে বিশাল খালটি ছিল তা দখল হয়ে গেছে। তাই এলাকার পানি নিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম খালটি উদ্ধারের দাবি জানায় এলাকাবাসী। স্থানীয় চনপাড়া এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব বাবুল মিয়া সিটি গ্রুপের এ প্রকল্পের জমি দেখিয়ে বলেন, ‘এখানে বড় আকৃতির একটি খাল ছিল। খালে সব সময় পানি থাকত। বৃষ্টি হলে পাশের এলাকার সব পানি গিয়ে খালে পড়ত। আর খাল থেকে পানি গিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে পড়ত। এখন সিটির (সিটি গ্রুপ) লোকজন খালসহ খাসজমি ভরাট করেছে। খালের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে।’
জলাধার সংরক্ষণ আইন মানা হচ্ছে না : জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ এবং সংশোধিত আইন ২০১০-এ জলাশয় ভরাটের শাস্তি হিসেবে জেল-জরিমানা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। মহানগর, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকা এবং দেশের সব পৌর এলাকার জলাশয়ও রয়েছে এ আইনের আওতায়। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন সংশোধনী বিল ২০১০-এ সংশোধনী আইন রয়েছে। সংশোধনী আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, জলাশয়ের কোনোরূপ শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। বিধির ৪ ধারার উপ-ধারা ‘চ’-এ বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক জলাধার, যেমন নদী, খাল, বিল, দীঘি, ঝরনা বা জলাশয় হিসেবে মাস্টারপ্ল্যানে চিহ্নিত বা সরকার, স্থানীয় সরকার বা কোনো সংস্থা কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, বন্যা, প্রবাহ এলাকা হিসেবে ঘোষিত কোনো জায়গা এবং বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোনো ভূমিও এ আইনের অন্তর্ভুক্ত হবে। জলাশয় ভরাটে দুই থেকে ১০ বছরের জেল, এক থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।



No comments:
Post a Comment