ধর্ম ও আদর্শের প্রশ্নে আশা-আকাঙ্ক্ষার সমর্থনে - সময়ের প্রতিধ্বনি

Breaking

Home Top Ad

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Saturday, August 27, 2016

ধর্ম ও আদর্শের প্রশ্নে আশা-আকাঙ্ক্ষার সমর্থনে


বিশ শতকের প্রথম পাদে বাঙালি মুসলমান সমাজে ধর্মজিজ্ঞাসা প্রবল হয়েছিল। তৎকালীন মাদ্রাসা-শিক্ষিত আলেম-সমাজ যেভাবে ইসলাম ও মুসলমানের কর্তব্য সম্পর্কে মত ব্যক্ত করতেন, তা নিয়ে নতুন ইংরেজি-শিক্ষিত লোকেরা সন্তুষ্ট হতেন না। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে ইসলাম ও মুসলমানের কর্তব্য বিষয়ক নানা প্রশ্নে তুমুল বিতর্ক দেখা দেয়।
এর মধ্যে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অল্প দিনের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে বিতর্কটি ঘনীভূত রূপ নেয়। নব্যশিক্ষিতদের পক্ষ থেকে তখন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামে আন্দোলন পরিচালনা করা হয়েছিল। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কালে এই আন্দোলনের কার্যক্রম চলে। নব্যশিক্ষিতেরা ক্রমে সংখ্যায় ও চিন্তাশক্তিতে বড় হতে থাকেন। পাকিস্তান-আন্দোলন, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা কর্মসূচি, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ­ এ সবই ঘটেছে নব্যশিক্ষিতদের দিয়ে। মুসলিম লীগ ধর্মের ব্যাপারে সুবিধাবাদী ভূমিকা নিয়ে এগিয়েছিল এবং পাকিস্তান-আন্দোলন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেই অত্যন্ত রক্ষণশীল ভূমিকা নেয়, ফলে নব্যশিক্ষিতদের বিকাশমান ধারা থেকে পিছিয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থীরা তত দিনে অতীতের গর্ভে বিলীন হয়। নব্যশিক্ষিতরা এগিয়েছিলেন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি আদর্শকে অবলম্বন করে। প্রাচীনপন্থীরা ছিলেন ইসলামের অতীতমুখী ব্যাখ্যা নিয়ে। দুই পক্ষের মধ্যে স্বার্থের সঙ্ঘাতও ছিল। মুসলিম লীগ ব্রিটিশ-শাসনের শেষ দিকটায় জাতীয়তাবাদের স্থলে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদ অবলম্বন করে এগিয়েছিল, এবং পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরেই পাকিস্তানে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদ আবেদনহীন হয়ে পড়ে। তাতে মুসলিম লীগ আদর্শহীন হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগ কখনো ধার্মিকদের সংগঠন ছিল না। সে পর্বে প্রাচীনপন্থী আলেম-সমাজের বিরুদ্ধে নব্যশিক্ষিতদের এবং সাধারণ মানুষের অভিযোগের অন্ত ছিল না। আলেম-সমাজের নেতৃত্বকে দায়ী করা হয়েছিল মুসলমান সমাজের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও পশ্চাৎবর্তীতার জন্য। তৎকালীন মাদ্রাসা-শিক্ষার বিরুদ্ধে বহুমুখী অভিযোগ তুলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অনুকূলে প্রবল জনমত গড়ে তোলা হয়েছিল। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি আদর্শ এবং মানুষের পার্থিব উন্নতির রাজনৈতিক বক্তব্য তখন ওয়াজ-নসিহত ও মিলাদ মহফিলের বক্তব্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি আকর্ষণীয় হয়েছিল সাধারণ অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত লোকদের কাছে­ যারা তখন ছিল মোট জনসংখ্যার নয়-দশমাংশের বেশি।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ১৯৭২ সালের শাসনতন্ত্রে ঘোষিত হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদকে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলে। আদর্শ যাই ঘোষণা করা হোক­ কোনোটারই প্রস্তুতি ছিল না কোনো রাজনৈতিক দলে। পরবর্তী কালেও কোনো রাজনৈতিক দল আদর্শগত প্রস্তুতির কথা ভাবেনি। বাস্তবে দেখা যায়­ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সার্বিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যায়। রাষ্ট্রীয় অপব্যবস্থা ও দুর্নীতির ফলে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি আদর্শ আবেদনহীন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকেই ধর্মের প্রতি মানুষের কিছুটা ঝোঁক দেখা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই সময় থেকে তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে দুর্বল গরিব দেশগুলোতে ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার নানা কৌশল অবলম্বন করে। মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলন তখনই পরিচালনা করা হয় আর বিবিসি ও তার সহযোগী প্রচারমাধ্যমগুলো এই দু’টি আন্দোলনকে প্রচার দিয়ে খুব সহায়তা করে। এরই মধ্যে ধর্মীয় শক্তি দ্রুত পুনরুজ্জীবিত হয়।
গণতন্ত্র যখন অপব্যবস্থায় নিপতিত হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার ফলে বিশ্বব্যবস্থা ওয়াশিংটন-কেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলন পরিচালিত হয়, তখন অশিক্ষিত- অর্ধশিক্ষিত লোকদের মধ্যে ধর্মের প্রতি ঝোঁক বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে এখন দেখা যাচ্ছে, অন্ধভাবে ধর্মের নামে এগোবার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। ধর্ম সম্পর্কেও মানুষ পুনরায় জিজ্ঞাসু হতে আরম্ভ করেছে। মানুষ গত প্রায় চার দশকের গণতন্ত্রে যেমন ভরসা পাচ্ছে না তেমনি গত প্রায় তিন দশকের ইসলামেও ভরসা পাচ্ছে না। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ঘটে গেছে। বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতি দুর্বৃত্তায়িত­ এ কথা ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পঁচানব্বই শতাংশ লোকের ভোট পড়ার পরেও এখনও বলা হচ্ছে। জনমনের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন এবং সন্দেহ বিরাজ করছে। দলীয় সঙ্কীর্ণতা ও জুলুম-জবরদস্তি কমছে না, আইনের শাসনও কায়েম হচ্ছে না। সামনে অবস্থা উন্নত হবে কি?

বাঙালি মুসলমান সমাজের মানসিকতার ও চিন্তা-ভাবনার অগ্রগতির নৈরাজ্যজনক ইতিহাস নিয়ে ভাবতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের চিত্তশুদ্ধির কথা মনে আসছে। চিত্তশুদ্ধিকে হিন্দুধর্মের সার বলে উল্লেখ করে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেনঃ
‘‘চিত্তশুদ্ধি থাকিলে সকল মতই শুদ্ধ, চিত্তশুদ্ধির অভাবে সকল মতই অশুদ্ধ। যাহার চিত্তশুদ্ধি নাই, তাহার কোনো ধর্ম নাই।... চিত্তশুদ্ধি কেবল হিন্দু ধর্মেরই সার, এমত নহে, ইহা সকল ধর্মের সার। ইহা হিন্দু ধর্মের সার, খ্রিষ্ট ধর্মের সার, বৌদ্ধ ধর্মের সার, ইসলাম ধর্মের সার, নিরীশ্বর কোঁৎ ধর্মেরও সার। যাঁহার চিত্তশুদ্ধি আছে, তিনি শ্রেষ্ঠ হিন্দু, শ্রেষ্ঠ খ্রিষ্টিয়ান, শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ, শ্রেষ্ঠ মুসলমান, শ্রেষ্ঠ পজিটিভিস্ট। যাঁহার চিত্তশুদ্ধি নাই, তিনি কোনো ধর্মাবলম্বীদিগের মধ্যেই ধার্মিক বলিয়া গণ্য হইতে পারেন না। চিত্তশুদ্ধিই ধর্ম।... চিত্তশুদ্ধি মানুষদিগের সকল বৃত্তিগুলির সম্যক স্ফূর্তি, পরিণতি ও সামঞ্জস্যের ফল।’’
এখানে যে চিত্তশুদ্ধির কথা বলা হয়েছে তা ধর্ম ও আদর্শের বেলায় সবচেয়ে মর্মগত ব্যাপার। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মপন্থী, গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী, জাতীয়তাবাদী­ কোনো দলের মধ্যেই এ ব্যাপারে কোনো সচেতনতার কিংবা জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যায় না। মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যে নফস, আহরিমান ও অসুর মাজদা, ফ্রয়েডে ইড, ইগো, সুপার ইগো­ ইত্যাদির কথা আছে। এসব নিয়েও চিন্তা-ভাবনা দেখা যায় না। এর ফলে এ দেশে ধর্ম, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ­ সবই ব্যর্থ হয়ে আসছে। সাফল্যের জন্য ধর্মপন্থী, গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী, জাতীয়তাবাদী­ সকলের মধ্যেই চিত্তশুদ্ধির ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত অনুশীলন দরকার। চিত্তশুদ্ধি চূড়ান্তভাবে অর্জন করার কোনো ব্যাপার নয়, চিত্তশুদ্ধি জীবনব্যাপী নিরন্তর অনুশীলনের ব্যাপার। চিত্তশুদ্ধিতে পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হয় না; তবে পূর্ণতা অর্জনের জন্য ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়।

চিত্তশুদ্ধি ব্যাপারটিকে বুঝতে হলে মনোবিজ্ঞানের দিক দিয়ে মানুষের বৃত্তি-প্রবৃত্তির, কামনা-বাসনার ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকৃতিকে, তাদের মধ্যকার বিরোধ ও সামঞ্জস্যের প্রয়োজনকে বুঝতে হবে। নীতিবিজ্ঞানের দিক দিয়ে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে বৃত্তি-প্রবৃত্তির, কামনা-বাসনার ও আশা-আকাঙ্ক্ষার পারস্পরিক বিরোধের প্রকৃতি, সামঞ্জস্যের সমস্যাবলি এবং সামঞ্জস্যের উপায় বিবেচনা করতে হবে­ সব সময় বিবেচনা করতে হবে। মনোবিজ্ঞানের দিক দিয়ে বিষয়টিকে বিবেচনা করতে গেলেই দেখা যাবে­ মানবীয় বৃত্তি-প্রবৃত্তি, কামনা-বাসনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার অন্তর্গত দিকের মতোই রয়েছে বাহ্য দিক। অন্তর্গত দিকের মধ্যে রয়েছে মানুষের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুমণ্ডলী।

মস্তিষ্ক ও স্নায়ুমণ্ডলীকে অবলম্বন করেই বৃত্তি-প্রবৃত্তি কামনা-বাসনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার অস্তিত্ব। মানুষের স্নায়ুমণ্ডলী জাগ্রত হয় ও সক্রিয় হয় বাইরের নানা কিছুর স্পর্শে ও প্রভাবে। এ জন্যই এক দিকে অন্তর্গত, অপর দিকে বহির্জগৎ। একদিকে অহং, অপর দিকে ইদং। দুটো অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত। এ জন্য মানবীয় সমস্যাবলির বিচারের ও সমাধানের বেলায় মনোজগত ও বৈষয়িক দুই দিককার তথ্যাবলিকেই বিবেচনায় ধরতে হবে। এক দিকে মনোবিজ্ঞান ও নীতিবিজ্ঞান এবং অপর দিকে অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান ইত্যাদি। ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত কাজের বেলায় দুটো দিককেই পরিপূর্ণ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে পথ চলতে হবে।
চিত্তশুদ্ধি ব্যাপারটিকে এভাবেই, দু’দিক থেকে দেখতে হবে। শুধু আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে বিষয়টিকে গ্রহণ করলে তাতে কোনো সুফল হবে না। প্রাচীনপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি নয়, চাই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। শুধু আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, চাই বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি। আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলোঃ সমর্থক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতে হবে­ নঞর্থক দৃষ্টিভঙ্গি নয়।

গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ­ এসবে সফল হওয়ার জন্য ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক জীবনে যে চরিত্রবল দরকার, তা জন্মগতভাবে মানুষ লাভ করে না, তা তাকে টেষ্টার মধ্য দিয়ে, সাধনার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হয়। এই অর্জনের জন্য রাজনীতিতে­ রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে অনুশীলন চালাতে হয়। দলের ভেতরে সকলকে চরিত্র অনুশীলন করতে হয়। চরিত্র কোনো নিশ্চল, সারাজীবনের জন্য অর্জন করে নেয়ার ব্যাপার নয়। চরিত্রও এমন এক ব্যাপার যে, এর জন্য জীবনব্যাপী নিরন্তর অনুশীলন দরকার হয়।

রাষ্ট্রসৌধের ভিত্তিতে রয়েছে জনগণের, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের, বৃত্তি-প্রবৃত্তির, কামনা-বাসনার, আশা-আকাঙ্ক্ষার কাঠামো। সেই কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত আছে এক দিকে মানুষের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুমণ্ডলী এবং অপর দিকে বস্তুগত সম্পদ। এইসব দিক দিয়ে ধর্ম ও আদর্শকে দেখতে হবে।

No comments:

Post a Comment

Post Bottom Ad

Responsive Ads Here

Pages