রাজধানীর গুলশানের রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার অন্যতম পরিল্পনাকারী রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাস গান্ধী ওরফে শান্ত’র ছবি প্রকাশ করেছে তদন্ত সংস্থা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিট।
সোমবার রাতে তদন্ত সংস্থা থেকে গুলশান হামলার অন্যতম এই পরিকল্পনাকারীর ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে।
এর আগে দুপুরে সোমবার দুপুরে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম রাজিব গান্ধীসহ নতুন করে আরো জঙ্গি নাম প্রকাশ করে।
এসময় কাউন্টার টেরিজিম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, নতুন চারজন হলো- রিপন, খালিদ, বাসারুল্লাহ এবং রাজীব গান্ধী। এদের মধ্যে বাসারুল্লাহ এবং রাজীব গান্ধী দেশেই আছে আর রিপন ও খালিদ গত এপ্রিল মাস থেকে ভারতে পালিয়ে আছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রেজাউল ইসলাম হত্যার পর তারা পালিয়ে যায়। এরপর তারা দেশে ফিরেছেন এমন কোন তথ্য নেই পুলিশের কাছে।
রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাস গান্ধী ওরফে শান্ত হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের কমান্ডিং পর্যায়ের নেতা। গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার আগে যখন জানতে পারলেন, হামলার জন্য প্রশিক্ষিত জনশক্তি দরকার। তখন রাজীব গান্ধী গুলশান হামলার জন্য দুজন এবং শোলাকিয়ায় হামলার জন্য একজন প্রশিক্ষিত জঙ্গিকে সরবরাহ করেন। যারা উভয় হামলার ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা যান।
রাজীব গান্ধী এখন কোথায় আছে জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, রাজীব গান্ধী গোয়েন্দা তথ্যমতে উত্তরাঞ্চলের কোনো একটি জেলায় আত্মগোপন করে আছে। তাকে ধরার জন্য অভিযান অব্যাহত আছে।
তিনি বলেন, গাইবান্ধার চরে কয়েক বছর আগে যেসব জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছিল তাদের মধ্যে রাজীব গান্ধী, তামীম চৌধুরী, মেজর মুরাদ, তানভীর কাদেরী ওরফে করিম, বাসারুল্লাহ, মারজান, রিপন, খালিদ অন্যতম ছিল। এদের মধ্যে বেশির ভাগ জঙ্গিই বিভিন্ন অভিযানে মারা যায়।
গুলশানে হামলার পর কল্যানপুর অপারেশন স্ট্রম-২৬ এর অভিযানে চার জনের মতো কমান্ডিং পর্যায়ের জঙ্গি নেতা মারা যায়। এরপর নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় তামীম চৌধুরীসহ তিন জন মারা যায়। যারা কমান্ডিং পর্যায়ের অন্যতম নেতা ছিলেন। সেখান থেকে রুপনগরে আরেক জঙ্গি নেতা মেজর মুরাদ ওরফে জাহিদুল মারা যায়।
সর্বশেষ আজিমপুরের ঘটনায় যিনি নিহত হয়, তার নাম তানভীর কাদেরী। এই তানভীর কাদেরীও একই সঙ্গে কমান্ডিং এবং অপারেশনের পরিকল্পনামাফিক নেতা ছিল।গুলশান ও শোলাকিয়ার মতো হামলার ঘটনায় তারা সর্বশক্তি বিনিয়োগ করেছিল। তামীম চৌধুরী সমন্বয়কারী ও প্রচার প্রচারণার কাজ করতো।
মনিরুল ইসলাম বলেন, একাধিক অভিযানে নব্য জেএমবির কমান্ডিং পর্যায়ের নেতারা নিহত হওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, নব্য ধারার জেএমবির ৬০-৭০ শতাংশ শক্তি ক্ষয় হয়েছে। কিন্তু এখনো বাসারুল্লাহ, মারজান আর গান্ধীর মতো সংগঠক যারা দেশে আছে, তাদের ধরতে না পারলে এখন ঝুকিতে আছি আমরা। তবে দেশে আর যাতে এ ধরণের কোন হামলা না ঘটে সেইজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রস্তুত রয়েছে।
নারী জঙ্গিদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আজিমপুর থেকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার হওয়া তিন নারী জঙ্গির পরিচয় মিলেছে। তাদের স্বামীরা সবাই জঙ্গি নেতা। একজন মারজানের স্ত্রী, একজন নিহত জঙ্গি তানভীর কাদেরীর স্ত্রী এবং অন্যজন বাসারুল্রাহর স্ত্রী। এই বাসারকে অনেকে চকলেট নামে চেনে। জঙ্গিদের অনেকেই তাকে চকলেট বাসার নামে ডেকে থাকেন।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, গুলশান ও শোলাকিয়া হামলায় সর্বোচ্চ ও সর্বোশক্তি বিনিয়োগ করেছিল নব্য জেএমবি। তবে বিভিন্ন অভিযানে নব্য জেএমবি’র কমাণ্ডিং পযায়ের বেশ কয়েকজন নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের মোটামুটি ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ শক্তি ক্ষয় হয়েছে। নব্য জেএমবি এখনো শেষ হয়ে যায় নি। মোট ৪ ভারতে অবস্থান করছে। গত এপ্রিলে ২জন ও সম্প্রতি দুজন পালিয়েছে। তারা এখন নব্য জেএমবি’র কমাণ্ডিং পর্যায়ের। আর কোনো হামলা যাতে না হয় সেজন্যও অভিযান চলছে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
মনিরুল বলেন, আমরা মনে করছি, তদন্তেও বেড়িয়ে এসেছে, গুলশান ও শোলাকিয়া হামলায় তারা সর্বোচ্চ ও সর্বোশক্তি বিনিয়োগ করেছিল। তাদের লিডারশীপের বেশ কয়েকজন গুলশান, শোলাকিয়া হামলার পর নিহত হয়েছে। কল্যাণপুরে অন্তত ছোট বড় সব মিলে ৪ জন কমাণ্ডার পর্যায়ের মারা গেছে, মূল কো-অর্ডিনেটর তামিম চৌধুরী, অর্থ যোগান ও সমন্বয় ও যোগাযোগের কাজটি তামিম চৌধুরীই করতো। সে নারায়ণগঞ্জে মারা গেছে।
তিনি জানান, পরবর্তি পর্যায়ে মেজর জাহিদ ও তানভীর কাদেরী নের্তৃত্ব দিয়েছে। মিরপুরের রূপনগরে প্রশিক্ষক ছিলেন জাহিদুল ইসলাম (মেজর মুরাদ)। জঙ্গিদের জন্য বিভিন্ন জায়গায় বাসা ভাড়া করে দেওয়ার সমন্বয়কারী জঙ্গি তানভীর (করিম)।
এরাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারাও অভিযানে মারা গেছে।তবে এখন মারজান বা গান্ধি ছাড়া আরও দুজন ইন্ডিয়ায় পালিয়েছে। রাজশাহীর প্রফেসর রেজাউল করিম হত্যার পর রিপন ও খালিদ নামে দুজন গত এপ্রিলে ইন্ডিয়ায় পালিয়ে যায়। তবে তাদের দেশে ফিরে আসার খবর এখনো পাওয়া যায় নি।
মনিরুল ইসলাম বলেন, আমরা মনে করছি, নব্য জেএমবি’র ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ শক্তি ক্ষয় হয়েছে। তবে এখনো পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় নি। যেহেতু এখনো মারজান, রিপন, খালিদ ও বাশারুজ্জামানের মতো লিডার বাইরে রয়েছে। বাদ বাকি লিডারশীপ ও শক্তি ধ্বংস করতে অভিযান চলছে।
তিনি আরো বলেন, ফেরদৌসি আফরিন, আবেদাতুল ফাতেমা ও শায়লা আফরিন চিকিৎসাধীন রয়েছে। আজিমপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া বাসারুজ্জামানের সন্তান সাবিহা জামানকে নানার জিম্মায় দেয়া হয়েছে। জাহিদুল হকের সন্তান জুনায়রা পিংকিকে দাদার জিম্মায় দেয়া হয়েছে। নিহত তানভীর কাদেরীর কিশোর ছেলে তাহরীর কাদেরী রাসেলকে (১৪) ঢাকার শিশু আদালতের নির্দেশে রিমান্ডে এনে দক্ষ অফিসারের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ভারত হয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। প্রায় ১৪ লাখ টাকা মধ্যপ্রাচ্য থেকে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে সরবরাহ করা হয়েছিল বলে দাবি করে মনিরুল ইসলাম বলেন, গুলশান, শোলাকিয়া, কল্যাণপুরের স্টর্ম ২৬, নারায়ণগঞ্জের হিট স্ট্রং ২৭ এর ঘটনা পর্যালোচনা ও তদন্ত করছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এর একটা বড় ধরণের চিত্র আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি তদন্তে। এর পেছনে কে বা কারা জড়িত, তা অনেকটা নিশ্চিত। তদন্তে যাদের নাম এসেছে তাদেরই কেউ কেউ অভিযানে নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে। কেউ জীবিত আটক হয়েছে। কয়েকজনকে আটকের জন্য অভিযান চলছে।
তিনি বলেন, গুলশান, শোলাকিয়া হামলায় জড়িতদের প্রধান ট্রেইনার ছিলেন আবু রায়হান তারেক। যিনি কিনা গাইবান্ধায় জঙ্গিদের ট্রেনিং দিয়েছেন। তিনি কিন্তু অভিযানে নিহত হয়েছেন।
অস্ত্রের যোগান সম্পর্কে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কল্যাণপুরের অভিযানে জীবিত উদ্ধার রিগ্যানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক তথ্য মিলেছে। গুলশান ও শোলাকিয়া হামলায় জড়িত জঙ্গিদের ব্যবহৃত অস্ত্র এসেছিল ভারত হয়ে। তবে তা বাংলাদেশ থেকে ভারত হয়ে আবার বাংলাদেশে আনা হয়েছে কিনা, কিংবা অন্য কোনো রুট দিয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশে এসেছে কিনা তা জানা যায় নি। তবে এটা নিশ্চিত যে, অস্ত্র ভারত হয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
মনিরুল ইসলাম জানান, অস্ত্রের যোগানদাতা কে বা কারা তা জানার চেষ্টা চলছে। আরও যাদের নাম বিভিন্ন ঘটনায় উঠে এসেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে।
তিনি বলেন, গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার জন্য প্রায় ১৩ লাখ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছে। ইতোমধ্যে অর্থের যোগানস্থল নিশ্চিত হওয়া গেছে। জড়িত দু’একজনের নামও জানা গেছে। তবে ঠিক বাংলাদেশ থেকে কোনো ব্যক্তি এই অর্থ পাঠিয়ে আবারও বাংলাদেশে পাঠিয়ে কিনা নিশ্চিত নয়।
তিনি আরো বলেন, গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলায় খরচ করতে হুণ্ডির মাধ্যমে প্রায় ১৩ লাখ টাকা বাংলাদেশ থেকে কে গ্রহণ করেছিল তাও জানা গেছে। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
প্রসঙ্গত, গুলশান-শোলাকিয়া হামলার ঘটনায় অপারেশনে ৭ জন জঙ্গি সদস্য নিহত হয়। এবং পরবর্তীতে কল্যানপুর, নারায়ণগঞ্জ ও রূপনগরের অপারেশনে আরো ১৩ জন জঙ্গি সদস্যর মৃত্যু হয়। নিহত ২০ জন জঙ্গির মধ্যে মাস্টারমাইন্ড থেকে শুরু সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্যরা রয়েছে।
No comments:
Post a Comment