চুক্তি অনুযায়ী গ্যাস ফিল্ড থেকে কনডেনসেট নিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিক্রি করার কথা থাকলেও তা মানছে না বেসরকারি ১৩টি রিফাইনারি।
কনডেনসেট থেকে উৎপাদিত পণ্য বিভিন্ন পেট্রলপাম্পে বিক্রি করে সরকারের ১ হাজার ৫৮৬ কোটি ১২ লাখ ২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এসব কোম্পানি।
দীর্ঘদিন ধরে চুক্তি ভঙ্গ করে খোলাবাজারে ডিজেল, অকটেন, কেরোসিন বিক্রি করা হলেও তা নিয়ন্ত্রণে কোন পদক্ষেপ নেয়নি বিপিসি। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিপিসির এক শ্রেণির কর্মকর্তারাই দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এ ধরনের কাজে সহায়তা করেছে বেসরকারি রিফাইনারিগুলোকে।
কারণ হিসেবে তারা বলছেন, গ্যাস ফিল্ড থেকে কি পরিমাণ কনডেনসেট উত্তোলন করা হয়েছে এবং তার বিপরীতে কি পরিমাণ পণ্য সরকারি তেল কোম্পানির (পদ্মা, মেঘনা, যমুনা) কাছে বিক্রি করা হয়েছে সে তথ্য প্রতিমাসে বিপিসিকে দেওয়ার কথা। কিন্তু সে দায়িত্ব বিপিসি কর্মকর্তারা সঠিকভাবে পালন না করায় এ ধরনের অনিয়ম হয়েছে।
বাইরে বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করে বেসরকারি রিফাইনারি মালিকরা বলছেন, বিপিসি থেকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া কোম্পানী তেল নিতে আগ্রহ না দেখানোর কারণে বাইরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তারা।
দীর্ঘদিন ধরে তেল সেক্টরে নৈরাজ্য চলে আসলেও সম্প্রতি অবৈধ তেল বিক্রি বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে বিপিসি। অনিয়মের কারণে কয়েকটি রিফাইনারিতে কনডেনসেট দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সবগুলো কোম্পানিকে সরকারি নিয়ম মেনে তেল বিক্রি এবং প্রতি মাসে তথ্য সরবরাহ করার নির্দেশ দিয়েছে।
এদিকে, বিপিসির কাছে দেশে উৎপাদিত কনডেনসেটের হিসেব থাকলেও আমদানিকৃত কনডেনসেটের কোন তথ্য নেই। এই সুযোগে পেট্রোম্যাক্স রিফাইনারি লিমিটেড কনডেনসেট আমদানি করে বাইরে বিক্রি করে দিচ্ছে। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অন্যদিকে কনডেনসেট মিশিয়ে ভেজাল তেল বিক্রি করছে পেট্রলপাম্পগুলো।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা ১৩টি বেসরকারি কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টের মধ্যে সবগুলোই সরকারি নিয়ম না মেনে খোলাবাজারে কনডেনসেট বিক্রি করেছে। এই সুযোগে গড়ে উঠেছে ভেজাল তেল বিক্রির একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তেল বিক্রি করে ১৩টি বেসরকারি রিফাইনারি সরকারের প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
দীর্ঘদিন চুপ থাকলেও অবশেষে নড়েচড়ে বসেছে বিপিসি। চুক্তি অনুযায়ী তেল না দেওয়ায় ১৩টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।এরই মধ্যে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিপিসির পরিচালক (বিপণন) মো.আলী রেজা।
তিনি বলেন, যেসব কোম্পানী চুক্তি অনুযায়ী জ্বালানি দেয়নি তাদের কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে অবশিষ্ট জ্বালানি বা সম পরিমাণ টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিতে হয়েছে। নির্দেশনা না মানলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।
পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গোল্ডেন কনডেনসেট অয়েল রিফাইনারি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পেট্রোবাংলা থেকে ২৩ হাজার ৩৮ টন কনডেনসেট গ্রহণ করে। এর বিপরীতে বিপিসির কাছে জ্বালানি পণ্য (পেট্রল, অকটেন, ডিজেল) সরবরাহ করেছে মাত্র ৯৮ টন। অর্থাৎ মাত্র শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ জ্বালানি সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন জ্বালানি সরবরাহ করেছে চিটাগাং ভেজিটেবল অয়েল (সিভিও) রিফাইনারি। প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরে পেট্রোবাংলা থেকে ১৯ হাজার ৪১৫ টন কনডেনসেট নিয়ে পরিশোধন শেষে বিপিসিকে দিয়েছে মাত্র ৭৯৯ টন অর্থাৎ ৪ দশমিক ১২ শতাংশ জ্বালানি পণ্য।
এ ছাড়া চৌধুরী রিফাইনারি ১১ হাজার ২৬৩ টন কনডেনসেট নিয়ে জ্বালানি পণ্য সরবরাহ করেছে মাত্র ৭১৪ টন। সুপার রিফাইনারি প্রাইভেট লিমিটেড পেট্রোবাংলা থেকে ৫৫ হাজার ৬৪৬ টন কনডেনসেট গ্রহণ করে মাত্র ৯ হাজার ৪৩৫ টন জ্বালানি পণ্য দিয়েছে বিপিসিকে। একইভাবে অ্যাকোয়া মিনারেল টারপেন্টাইন অ্যান্ড সলভেন্টস প্লান্টস লিমিটেড ৩৭ হাজার ৩১১ টন কনডেনসেট নিয়ে বিপিসিকে দিয়েছে ২৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ জ্বালানি পণ্য।
জেবি রিফাইনারি ১১ হাজার ১৮৪ টন নিয়ে বিপিসিকে দিয়েছে ৪ হাজার ৪২ টন, ইউনিভার্সেল রিফাইনারি লিমিটেড ১১ হাজার ৫০১ টন নিয়ে বিপিসিকে দিয়েছে ৪ হাজার ২৩৯ টন, সিনথেটিক রেজিন প্রডাক্টস লিমিটেড ১৮ হাজার ১১২ টন নিয়ে বিপিসিকে দিয়েছে ৩ হাজার ৫৮৯ টন, লার্ক পেট্রোলিয়াম কোম্পানি ১৮ হাজার ৬৮১ টন নিয়ে দিয়েছে ১ হাজার ৫৫৭ টন, রূপসা রিফাইনারি লিমিটেড ১৭ হাজার ৪৪০ টন নিয়ে বিপিসিকে দিয়েছে ২ হাজার ৩১৭ টন।
এ ছাড়া সুপার পেট্রো কেমিক্যাল লিমিটেড ২৫ হাজার ৮৭৬ টনের বিপরীতে ৩১ হাজার ৬২৯ টন এবং পেট্রোম্যাক্স রিফাইনারি লিমিটেড ৭৬ হাজার ৭০৫ টনের বিপরীতে ৯০ হাজার ৩৪৪ টন দিয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। কিন্তু গ্রহণের চেয়ে বেশি দেওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ যে পরিমাণ কনডেনসেট উত্তোলন করা হয় তার চেয়ে কম ছাড়া বেশি দেওয়া কোনভাবে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে এই দুই কোম্পানী বিদেশ থেকে আমদানি করা কনডেনসেট’র তথ্য গোপন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জ্বালানি তেল বিক্রির ক্ষেত্রে কিছু অনিয়ম হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন ইউনিভার্সেল রিফাইনারি লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা.মঈনুল ইসলাম মাহমুদ।
বিপিসি তেল না নেওয়ার কারণে অনেকে বাইরে বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছেন অ্যাকোয়া মিনারেল টারপেন্টাইন এন্ড সলভেন্টস এমডি ও পেট্রোকেমিক্যাল রিফাইনারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র সভাপতি ইরসাদ হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের ভেতরে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান অসাধু ব্যবসায়ীর পাল্লায় পড়ে অনিয়ম করেছে।
লাইট ন্যাফথা নিয়ে কনডেনসেটের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করার অভিযোগের বিষয়ে সুপার পেট্রোকেমিক্যাল লিমিটেড এর প্রধান নির্বাহী প্রণব সাহা বলেন, আমরা ন্যাফথা আমদানি করিনি। আমাদের কাছে কেউ তথ্যও চায়নি।
No comments:
Post a Comment